
নতুন না পুরাতন, কোন প্রাইজবন্ড কিনবেন?
প্রাইজবন্ড কেনার সময় প্রায়শই একটি প্রশ্ন মনে আসে—নতুন প্রাইজবন্ড কিনবো নাকি পুরাতন? এই দুটি বিকল্পের মধ্যে কোনটি আপনার জন্য সেরা হবে, তা নির্ভর করে আপনার ব্যক্তিগত প্রয়োজন এবং পছন্দের ওপর। সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য চলুন নতুন ও পুরাতন প্রাইজবন্ডের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো ভালোভাবে জেনে নিই।
নতুন প্রাইজবন্ড কী?
যে প্রাইজবন্ড বিক্রির তারিখ থেকে পরবর্তী ড্র পর্যন্ত দুই মাসের কম সময় পার হয়েছে, সেটিকেই নতুন প্রাইজবন্ড বলা হয়। এই বন্ডগুলো সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ইস্যু করা হয়। দেখতে একদম নতুন এবং কাগজের গুণগত মান ভালো হওয়ায় অনেকেই এটি পছন্দ করেন।
নতুন প্রাইজবন্ডের সুবিধা ও অসুবিধা
নতুন প্রাইজবন্ড কেনার কিছু সুবিধা আছে, যা এর অসুবিধার তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে উভয় দিক বিবেচনা করা জরুরি।
সুবিধাসমূহঃ
✧ নিশ্চিন্তে কেনা যায়: নতুন প্রাইজবন্ড যেহেতু সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখা থেকে কেনা হয়, তাই এতে জালিয়াতির কোনো সুযোগ থাকে না। আপনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে একটি আসল এবং সুরক্ষিত বন্ড কিনতে পারছেন। বাজারের অন্যান্য উৎস থেকে বন্ড কেনার ক্ষেত্রে যে ঝুঁকি থাকে, নতুন বন্ডের ক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণভাবে এড়ানো সম্ভব।
✧ সিরিয়াল ঠিক থাকে: নতুন প্রাইজবন্ড সাধারণত একই সিরিজের এবং ক্রমানুসারে (সিরিয়াল অনুযায়ী) পাওয়া যায়। এর ফলে আপনার কাছে একাধিক বন্ড থাকলেও ড্রয়ের ফলাফল মেলানো খুবই সহজ হয়। আপনাকে এলোমেলো নম্বরের ভিড়ে সঠিক নম্বর খুঁজতে গিয়ে সময় নষ্ট করতে হয় না।
✧ আকর্ষণীয়: নতুন বন্ডের ঝকঝকে চেহারা এবং কাগজের সুঘ্রাণ এটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। অনেকে উপহার হিসেবেও নতুন বন্ড কেনা পছন্দ করেন, কারণ এটি দেখতে সুন্দর এবং সুরক্ষিত বলে মনে হয়।
অসুবিধাসমূহঃ
✭ অপেক্ষার পালা: নতুন প্রাইজবন্ড কিনলে আপনাকে ড্রতে অংশ নেওয়ার জন্য কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হয়। কোনো বন্ড ড্রতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য এটি কেনার তারিখ থেকে দুই মাস অতিবাহিত হওয়া আবশ্যক। তাই আপনি যদি ড্রয়ের মাত্র এক মাস আগে একটি নতুন বন্ড কেনেন, তাহলে পরবর্তী ড্রতে অংশগ্রহণের জন্য আপনাকে প্রায় চার মাস অপেক্ষা করতে হবে। এটি অনেকের জন্যই আগ্রহ কমিয়ে দেয়।
✭ প্রাপ্তিস্থানের সীমাবদ্ধতা: নতুন প্রাইজবন্ড শুধুমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখাগুলোতে পাওয়া যায়। এটি একটি বড় অসুবিধা, কারণ সব জেলা বা শহরে বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখা নেই। ফলে যারা মফস্বলে বা দূরবর্তী এলাকায় থাকেন, তাদের পক্ষে নতুন বন্ড কেনা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এটি পুরাতন প্রাইজবন্ডের তুলনায় নতুন বন্ডের একটি উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা।
পুরাতন প্রাইজবন্ড কী?
যে প্রাইজবন্ড বিক্রির তারিখ থেকে দুই বছর বা তার বেশি সময় পার হয়েছে, তাকে পুরাতন প্রাইজবন্ড বলা হয়। এই বন্ডগুলো সাধারণত বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক বা পোস্ট অফিসে পাওয়া যায়।
পুরাতন প্রাইজবন্ডের সুবিধা ও অসুবিধা
সুবিধাসমূহ:
✧ তাৎক্ষণিক ড্র-তে অংশগ্রহণের সুযোগ: পুরাতন প্রাইজবন্ড কেনার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, কেনার পর পরই আপনি পরবর্তী ড্রতে অংশ নিতে পারবেন। আপনাকে নতুন বন্ডের মতো দুই বা চার মাস অপেক্ষা করতে হবে না। এই তাৎক্ষণিক অংশগ্রহণের সুযোগটি প্রাইজবন্ড সংগ্রাহকদের জন্য খুবই লোভনীয়।
✧ পুরোনো পুরস্কার জেতার সম্ভাবনা: এটি একটি অপ্রত্যাশিত এবং অত্যন্ত আকর্ষণীয় সুবিধা। অনেকেই প্রাইজবন্ডের ফলাফল যাচাই করার ঝামেলার কারণে পুরস্কার জেতার পরেও তা তুলে নেন না। গত কয়েক বছরে প্রায় ৫০% বিজয়ী তাদের পুরস্কার তোলেননি। এই অলসতার কারণে পুরস্কার না তোলা বন্ডগুলো বাজারে আবার বিক্রি হয়। আপনি যখন পুরাতন প্রাইজবন্ড কেনেন, তখন আপনার কাছে এমন বন্ড আসার সম্ভাবনা থাকে যা অতীতে কোনো না কোনো ড্রতে পুরস্কার জিতেছিল কিন্তু সেই পুরস্কারটি কেউ তোলেনি। তাই আপনি বন্ডটি কেনার পর থেকেই পূর্বের দুই বছরের ড্রয়ের ফলাফল মিলিয়ে দেখতে পারবেন। এমন চমকপ্রদ ঘটনাও ঘটে যে, একজন ব্যক্তি একটি পুরাতন প্রাইজবন্ড কিনেছেন এবং সেটি কেনার দিনই দেখা গেল যে এটি আসলে কয়েক মাস আগেই একটি বড় অঙ্কের পুরস্কার জিতেছিল!
✧ সহজলভ্যতা: নতুন প্রাইজবন্ড শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দিষ্ট শাখাগুলোতে পাওয়া গেলেও পুরাতন প্রাইজবন্ড বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং পোস্ট অফিসের শাখাগুলোতে সহজে পাওয়া যায়। এতে করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ যারা বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখার কাছে থাকেন না, তারাও সহজে প্রাইজবন্ড কিনতে পারেন।
অসুবিধাসমূহ:
✭ নম্বর মেলানোর জটিলতা: পুরাতন প্রাইজবন্ডের একটি বড় সমস্যা হলো এর নম্বর মেলানোর জটিলতা। যেহেতু এই বন্ডগুলো বিভিন্ন হাত ঘুরে বাণিজ্যিক ব্যাংক বা পোস্ট অফিসে আসে, তাই একটি নির্দিষ্ট সিরিয়ালে পাওয়া যায় না। সাধারণত, একজন গ্রাহক একবারে অনেকগুলো প্রাইজবন্ড কিনলে সেগুলোর নম্বরগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। ফলে হাতে হাতে যখন কেউ ড্রয়ের ফলাফল মেলাতে যায়, তখন অনেক সময় ও ধৈর্য লাগে। বিশেষ করে যদি আপনার কাছে শত শত বা হাজার হাজার বন্ড থাকে, তবে একটি একটি করে নম্বর মেলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন নতুন প্রাইজবন্ড বিক্রি করে না?
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নতুন প্রাইজবন্ড বিক্রি করতে কেন আগ্রহী নয়, এর পেছনে বেশ কিছু অর্থনৈতিক এবং ব্যবস্থাপনাগত কারণ রয়েছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, এটি তাদের জন্য একটি লাভজনক ব্যবসা নয়, বরং অতিরিক্ত বোঝা।
❅ মুনাফার অভাব: বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মূলত ঋণ দেওয়া, আমানত সংগ্রহ এবং বিভিন্ন আর্থিক সেবা থেকে মুনাফা অর্জন করে। কিন্তু প্রাইজবন্ডের ক্ষেত্রে, ব্যাংক ১০০ টাকার বন্ড ১০০ টাকাতেই বিক্রি করে। এতে তাদের কোনো কমিশন বা লাভ হয় না। তাই এটি তাদের মূল ব্যবসায়িক মডেলের সাথে মেলে না।
❅ মানবসম্পদ ও সময় নষ্ট: প্রাইজবন্ড বিক্রি করার জন্য একজন ব্যাংক কর্মকর্তাকে সময় দিতে হয়। তাকে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নেওয়া, বন্ড সরবরাহ করা এবং সমস্ত লেনদেনের হিসাব রাখা—এইসব কাজ করতে হয়। এই সময়টুকুতে সেই কর্মকর্তা ব্যাংকের জন্য আরও লাভজনক কোনো কাজে নিযুক্ত থাকতে পারতেন, যেমন: ঋণ বিতরণ বা নতুন গ্রাহক আনা।
❅ মূলধন আটকে থাকা: প্রাইজবন্ড বিক্রি করতে হলে ব্যাংককে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বন্ড তাদের শাখায় মজুত রাখতে হয়। এই মজুত রাখা বন্ডগুলোর মূল্য (প্রতিটি ১০০ টাকা) ব্যাংকের মূলধন থেকে আটকে যায়। এই টাকা অন্য কোনো লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করা সম্ভব হয় না। এই অলস টাকা ব্যাংকের জন্য একটি সুযোগ ব্যয় (opportunity cost) তৈরি করে।
❅ হিসাব রক্ষণাবেক্ষণের খরচ: প্রাইজবন্ডের প্রতিটি লেনদেন, প্রতিটি সিরিজ এবং নম্বর সঠিকভাবে রেকর্ড রাখতে হয়। এর জন্য একটি অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা এবং হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা প্রয়োজন, যা ব্যাংকের জন্য অতিরিক্ত খরচ সৃষ্টি করে।
এই কারণে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নতুন করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাইজবন্ড এনে স্টক করে বিক্রি করার চেয়ে গ্রাহকদের জমা দেওয়া পুরোনো বন্ডগুলো বিক্রি করাকেই বেশি সুবিধাজনক মনে করে। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আপনি পুরাতন প্রাইজবন্ডই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে দেখতে পাবেন।
শেষ কথা
বর্তমানে ডিজিটাল যুগে এলোমেলো সিরিয়াল বা সিরিজ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বা অ্যাপের মাধ্যমে সহজেই ফলাফল যাচাই করা সম্ভব। নতুন ও পুরাতন প্রাইজবন্ডের সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার পর এখন সিদ্ধান্ত আপনার। আপনার প্রয়োজন এবং সুবিধা অনুযায়ী কোনটি আপনার জন্য সেরা, তা বিবেচনা করে আপনি প্রাইজবন্ড কিনতে পারেন।
Latest Blog
৫২ বছরের নূরুল আমিন ১১৭তম প্রাইজবন্ড ড্র'তে প্রথম পুরস্কার জিতেছেন। তার প্রাইজবন্ডের নাম্বারটি হলো গ...
০২ নভেম্বর ২০২৪ ১৮,৭৬২
৩১শে জুলাই ২০২৪, বুধবার প্রাইজবন্ডের ১১৬তম ড্র অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই ড্র'তে মোট আশি সিরিজের প্রাইজবন্ডে...
৩১ জুলাই ২০২৪ ৩১,১০৭
পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাইজবন্ড উলটো করে ধরলে, যদি কেউ পূর্বে টাকা উত্তোলন করে থাকে, সেখানে একটি সিল দেওয়...
১২ অক্টোবর ২০২৪ ২,৮৯১
১২০তম প্রাইজবন্ডের ড্র ৩১শে জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হবে। এটি ৮২টি সিরিজের মধ্যেই পরিচালিত হ...
০১ জুন ২০২৫ ৭,৯৪২
বাংলাদেশের প্রাইজবন্ড ঢাকার গাজীপুরে অবস্থিত সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন বাংলাদেশ লিমিটেড (এসপিসিব...
২৮ মে ২০২৪ ২,২৮৬
১০০০ পিস প্রাইজবন্ড কিনেও পুরস্কার না পাওয়া হতাশাজনক হলেও এটি বাস্তব। তি ১০ লাখ প্রাইজবন্ডের মধ্যে...
০৬ জুন ২০২৪ ৩,৯১১
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আপনি এবং আমার মতো সাধারণ গ্রাহক হিসেবে কল্পনা করুন। যেমন আমরা প্রাইজবন্ড কেনা...
২৬ মে ২০২৪ ২,৭১৯
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল খুবই দুর্বল। দেশকে পুনর্নির্মাণের জন্য সরকারকে জনগণে...
২৬ মে ২০২৪ ২,১৮৫
শুধু যাদের সাথে আপনার জোড়া মিলবে তারাই আপনার ফোন নাম্বার দেখতে পাবে—অন্য কেউ দেখতে পাবে না। যদি তারা...
০৯ নভেম্বর ২০২৪ ২,৫০৮