প্রাইজবন্ড কর্তৃপক্ষের প্রতি খোলা চিঠি

প্রাইজবন্ড কর্তৃপক্ষের প্রতি খোলা চিঠি

গ্রাহক ভোগান্তি দূর করে প্রাইজবন্ডকে জনপ্রিয় করতে প্রাইজবন্ড কর্তৃপক্ষের প্রতি খোলা চিঠি। 

১৯৯৫ সালে ১০০ টাকার প্রাইজবন্ড চালু হওয়ার পর থেকে অনেক বছর পার হয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে তেমন কোনো গ্রাহকবান্ধব সংস্কার করা হয় নাই। প্রাইজবন্ড আরও জনপ্রিয় করতে গ্রাহকদের ভোগান্তি দূর করা এবং গ্রাহকবান্ধব প্রকল্প গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আমরা নিম্নে উল্লেখ করতে চাই:

১। লভ্যাংশের হার বৃদ্ধি:
বর্তমানে, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক ডিপোজিটে লভ্যাংশের হার ১০% এর উপরে থাকা সত্ত্বেও, প্রাইজবন্ডে লভ্যাংশের হার মাত্র ৬.৫%। এই বৈষম্যমূলক হার বাজারে প্রতিযোগিতাকে ব্যাহত করছে এবং প্রাইজবন্ডের আকর্ষণ কমিয়ে দিচ্ছে। প্রস্তাবিত এই প্রবন্ধে, আমরা প্রাইজবন্ডকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে এর লভ্যাংশের হার বৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করবো।

  ◑ বর্তমান পরিস্থিতির সমালোচনা:
     ⮚ কম লভ্যাংশের হার: প্রাইজবন্ডের ৬.৫% লভ্যাংশের হার অন্যান্য বিনিয়োগ বিকল্পের তুলনায় অনেক কম। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা প্রাইজবন্ডের প্রতি পূর্ণাঙ্গ আগ্রহ প্রকাশ করছেন না।
     ⮚ অপ্রতিযোগিতামূলক বাজার: বৈষম্যমূলক লভ্যাংশের হার বাজারে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা তৈরি করছে। সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক ডিপোজিট বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে, যার ফলে প্রাইজবন্ডের বিক্রি কমে যাচ্ছে।
     ⮚ সরকারের আয় হ্রাস: প্রাইজবন্ডের বিক্রি কমে গেলে সরকারের আয়ও কমে যাবে। এর ফলে, জাতীয় উন্নয়নমূলক প্রকল্পে অর্থায়নের অভাব দেখা দিতে পারে।

  ◑ প্রস্তাবিত সমাধান:
     ⮚ লভ্যাংশের হার বৃদ্ধি: প্রাইজবন্ডকে আরও আকর্ষণীয় করতে, এর লাভের হার বাড়ানো উচিত। বর্তমানে প্রস্তাবিত হার হল ৯.৭৫%।

২। ড্রয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি:
বর্তমানে, প্রতি তিন মাস অন্তর প্রাইজবন্ডের ড্র ঘোষণা করা হয়। লভ্যাংশের হার ৬.৫% থেকে ৯.৭৫% করা হলে ড্রর সংখ্যাও বছরে ৪টির পরিবর্তে ৬টি করা সম্ভব হবে। 
    ⮚ প্রস্তাবনা: তিন মাস অন্তর ড্রর পরিবর্তে প্রতি দুই মাস পর পর ড্র ঘোষণা করা উচিত। এর ফলে বছরে ৬টি ড্র অনুষ্ঠিত হবে, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় হবে।

৩। ২ মাস আগে প্রাইজবন্ড কেনার বাধ্যবাধকতা বাতিল:
প্রাইজবন্ডে পুরস্কার জয়ের সংখ্যা খুব কম থাকা সাপেক্ষে, অনেকেই প্রাইজবন্ড কেনার পর পুরস্কার প্রাপ্তির অধিকার অর্জন করতে পারছে না, যদিও তারা পুরস্কার জিতেছেন। এই বিধানটি বৈধ বিজয়ীদের পুরস্কার অর্থ প্রদানের উপর একটি সার্বজনীন প্রভাব ফেলছে এবং তাদের আর্থিক অবস্থায় একটি অসুবিধা তৈরি করছে।

একটি বাস্তব উদাহরণসহ সমস্যাটি বুঝার চেষ্টা করি।
গফ ০৮১৩০৪৬ নম্বর বন্ডটি ১০৯তম ড্রে পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হলেও তার পুরস্কার লাভ করতে পারেননি, কারণ এটির বিক্রয়ের তারিখ এবং ড্রের তারিখের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ছিল ১ মাস ২৪ দিন। এই বন্ডটি ৬ই সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে বিক্রি করা হয়েছিল এবং ১০৯তম ড্র ৩১শে অক্টোবর ২০২২ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সময়ের ব্যবধানে, বন্ডটি ২ মাসের পূর্ণ সময় ধারণ করা হয়নি, যার ফলে এটি পুরস্কারের জন্য অযোগ্য হয়ে পড়ে।

সচিত্র উদাহরণঃ

এখানে আমরা মাত্র একটি উদাহরণ তুলে ধরেছি, কিন্তু এই ধরনের অসংখ্য ভুক্তভোগী গ্রাহক রয়েছেন যারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন।

আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ড্র ঘোষণার দুই মাস পূর্বে প্রাইজবন্ড কেনার অযৌক্তিক নিয়মটি প্রত্যাহার করা উচিত। এটি প্রাইজবন্ডকে আরও গ্রাহকবান্ধব এবং আকর্ষণীয় করে তুলতে সাহায্য করবে।

৪। ট্যাক্স হার হ্রাস:
প্রাইজবন্ডের উপর মাত্র ৬.৫% লভ্যাংশের হার ইতোমধ্যেই বিনিয়োগকারীদের জন্য নিরুৎসাহজনক, এবং পুরস্কারের উপর আরও ২০% আয়কর আরও বাড়তি বোঝা। এটি যেন মরার উপরে খাড়ার ঘা!

আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, প্রাইজবন্ডকে আরও বিনিয়োগবান্ধব করে তুলতে হলে পুরস্কারের উপর আয়কর বাতিল করা উচিত। পুরস্কারের উপর আয়কর বাতিল করলে প্রাইজবন্ডকে আরও আকর্ষণীয় এবং লাভজনক বিনিয়োগের বিকল্প করে তুলবে, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য উপকারী হবে।

এই পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য, আমরা সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি যে তারা দ্রুত পুরস্কারের উপর আয়কর বাতিলের নীতি গ্রহণ করে।

৫। পুরস্কারের আবেদন পদ্ধতি সহজতর করা:
পুরস্কার প্রাপ্তির প্রক্রিয়াটি আরও সহজ করা উচিত। প্রাইজবন্ড আবেদন প্রক্রিয়াটিকে আরও সুবিধাজনক করতে, অনলাইন আবেদন ব্যবস্থা চালু করা উচিত। গেজেটেড অফিসারের সত্যায়নের পরিবর্তে মোবাইল ফোন ভেরিফিকেশন, জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) ব্যবহার করে অনলাইন যাচাই, বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে যাচাই ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যেতে পারে।

প্রস্তাবনাঃ 
⮚ অনলাইন আবেদন ব্যবস্থা চালু করা উচিত। এটি বিজয়ীদের আরও বেশি সুবিধা প্রদান করবে এবং তাদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা দূর করবে।
⮚ আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সংখ্যা কমিয়ে নেওয়া উচিত এবং প্রক্রিয়াটিকে আরও সহজ ও সম্পন্নভাবে করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
⮚ গেজেটেড অফিসার দ্বারা সত্যায়নের নিয়ম বাতিলঃ গেজেটেড অফিসার দ্বারা সত্যায়নের নিয়ম বাতিল করার দাবি দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্কিত ছিল। অনেকে মনে করেন যে, এই নিয়মটি অপ্রয়োজনীয় এবং গ্রাহকদের জন্য অস্বীকার্য। এই নিয়মটি পুরস্কার আদায়ের প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত জটিল করে তুলে দিয়েছে।

৬। যেকোনো ব্যাংকেই পুরস্কারের জন্য আবেদন:
বর্তমানে, প্রাইজবন্ড পুরস্কারের জন্য আবেদন শুধুমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংকের যেকোনো শাখার মাধ্যমেই করা সম্ভব। তবে এটি বিজয়ীদের জন্য কিছুটা অসুবিধা সৃষ্টি করে, বিশেষত যারা দূরবর্তী এলাকায় বসবাস করেন।
এই সমস্যাটি আরও ভালোভাবে বুঝতে, ধরুন ১০,০০০ টাকার পুরস্কার জিতেছেন থানা শহরের একজন বাসিন্দা। কিন্তু বিভিন্ন কাগজপত্র জোগাড় করে, গেজেটেড অফিসার কর্তৃক সত্যায়িত করিয়ে, উচ্চমূল্যের বাজারে গাড়ি ভাড়া করে আবেদন জমা দিতে হবে তাদের বাংলাদেশ ব্যাংকে। উল্লেখ্য, সারা দেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাত্র ১০টি শাখা রয়েছে, যা কেবলমাত্র বড় বড় শহরগুলোতে অবস্থিত। ডিজিটাল যুগে, গ্রাম বা থানা শহরের মানুষের জন্য এইসব শাখা অফিসে গিয়ে আবেদন করা কতটা অসুবিধাজনক তা সহজেই অনুমেয়।

আমাদের প্রস্তাবণা:
⮚ সারা দেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং পোস্ট অফিসের সকল শাখায় আবেদন জমা দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা উচিত। এটি বিজয়ীদের জন্য আরও সুবিধাজনক হবে এবং পুরস্কার আদায়ের প্রক্রিয়া সহজতর করবে।

৭। সকল ব্যাংকে প্রাইজবন্ডের বাধ্যতামূলক বিতরণ: সকল ব্যাংকেই প্রাইজবন্ড পাওয়া যায় না। ফলে গ্রাহকদের হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়। গ্রাহকরা তাদের সুবিধাজনক ব্যাংক থেকে প্রাইজবন্ড কিনতে পারছেন না। প্রয়োজনীয় ব্যাংক খুঁজতে সময় ও শ্রম ব্যয় হয়। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষের জন্য এই সমস্যা আরও বেশি প্রকট। সরকার একটি আইন প্রণয়ন করে সকল ব্যাংকেই প্রাইজবন্ড বিতরণ বাধ্যতামূলক করতে পারে। এতে গ্রাহকরা যেকোনো ব্যাংক থেকেই সহজে প্রাইজবন্ড কিনতে পারবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে সকল ব্যাংকে প্রাইজবন্ডের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা যেতে পারে। নিয়মিত মনিটরিংয়ের ফলে গ্রাহকদের চাহিদা মেটানো সহজ হবে।

৮। ডিজিটাল ও অনলাইন সুবিধা:
অনলাইনে প্রাইজবন্ড কেনার ও লেনদেনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে যাতে বিনিয়োগকারীদের জন্য আরও সুবিধা হয়। এছাড়া, ডিজিটাল প্রাইজবন্ড চালু করা এবং বিভিন্ন ধরনের পুরস্কার প্রদান করা যেতে পারে।

এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করলে প্রাইজবন্ডের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে এবং এটি বিনিয়োগের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে উভয়ক্ষেত্রে পরিচিত হবে।

৫,৬৩১ মন্তব্য (৩/১) ২২ মে ২০২৪

Latest Blog

প্রাইজবন্ড কিনলে কতদিন পর জিতবেন?
প্রাইজবন্ড কিনলে কতদিন পর জিতবেন?

প্রাইজবন্ডে যদিও পুরস্কার জেতার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম, তবুও মানুষ এই প্রাইজবন্ড কেনার মাধ্যমে নি...

২৯ মে ২০২৪ ৭,৬৮৫

১২০তম প্রাইজবন্ড ড্র, ৮২টি  ৬ লাখ টাকার প্রথম পুরস্কারসহ ৩৭৭২টি পুরস্কার।
১২০তম প্রাইজবন্ড ড্র, ৮২টি ৬ লাখ টাকার প্রথম পুরস্কারসহ ৩৭৭...

১২০তম প্রাইজবন্ড ড্র, ৮২টি ৬ লাখ টাকার প্রথম পুরস্কারসহ ৩৭৭২টি পুরস্কার।

৩১ জুলাই ২০২৫ ১০,৩৩৭

একজনের প্রাইজবন্ড নম্বর দিয়ে অন্য ব্যক্তি পুরস্কার নিতে পারবে?
একজনের প্রাইজবন্ড নম্বর দিয়ে অন্য ব্যক্তি পুরস্কার নিতে পার...

না, একজনের প্রাইজবন্ডের নম্বর দিয়ে অন্য কেউ পুরস্কার নিতে পারবে না। প্রাইজবন্ড একটি বাহক দলিল, তাই...

২৫ মে ২০২৪ ৪,৪০৭

প্রাইজবন্ড কিভাবে কিনতে হয়?
প্রাইজবন্ড কিভাবে কিনতে হয়?

সারাদেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০টি শাখা অফিস থেকে সারা বছর এবং যেকোনো সময় প্রাইজবন্ড কেনা যায়। এছাড়াও...

০৮ মে ২০২৪ ৯,০৮৪

জোড়া প্রাইজবন্ড সংগ্রহের প্রক্রিয়া আরও সহজ হলো।
জোড়া প্রাইজবন্ড সংগ্রহের প্রক্রিয়া আরও সহজ হলো।

শুধু যাদের সাথে আপনার জোড়া মিলবে তারাই আপনার ফোন নম্বর দেখতে পাবে—অন্য কেউ দেখতে পাবে না। যদি তারা প...

০৯ নভেম্বর ২০২৪ ৩,৫৭৬

প্রাচুর্য ডট কম এর SWOT Analysis একটি বিস্তারিত বিশ্লেষণ
প্রাচুর্য ডট কম এর SWOT Analysis একটি বিস্তারিত বিশ্লেষণ

প্রাচুর্য ডট কম একটি ভালো প্ল্যাটফর্ম হলেও, এটির আরো উন্নতি করার সুযোগ রয়েছে। প্রাচুর্য ডট কমের শক্...

১৫ জানুয়ারী ২০২৫ ২,৯০২

সরকার পতনে প্রাইজবন্ডের নিরাপত্তা কতটুকু?
সরকার পতনে প্রাইজবন্ডের নিরাপত্তা কতটুকু?

সরকার পতনের কারণে প্রাইজবন্ডের কার্যক্রমে কিছুটা বিলম্ব হতে পারে বা কিছু নিয়মে পরিবর্তন আসতে পারে।...

০৮ আগষ্ট ২০২৪ ৩,২৪৮

বরিশাল বিভাগের জন্য প্রাইজবন্ড ড্র কবে হবে?
বরিশাল বিভাগের জন্য প্রাইজবন্ড ড্র কবে হবে?

প্রাইজবন্ড ড্র সারা বাংলাদেশের জন্য একই দিনে এবং একই প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়। প্রাইজবন্ড ড্র বরিশা...

০৫ জুন ২০২৪ ২,৮৯৯

জোড়া প্রাইজবন্ডে ডাবল পুরস্কারের রহস্য!
জোড়া প্রাইজবন্ডে ডাবল পুরস্কারের রহস্য!

জোড়া প্রাইজবন্ডটি ড্র’তে উঠে, তাহলে আপনি একই সঙ্গে দুটি  বা তিনটি পুরস্কার পাবেন। এটি একটি স্মার্ট ব...

৩০ জুলাই ২০২৪ ৪,৩৬৭

প্রাইজবন্ড সম্পর্কিত ব্লগ সমূহ