প্রাইজবন্ডে বিনিয়োগ ঝুকিমুক্ত কি না?

প্রাইজবন্ডে বিনিয়োগ ঝুকিমুক্ত কি না?

প্রাইজবন্ড সরকার কর্তৃক পরিচালিত একটি সঞ্চয় স্কিম যেখানে নিয়মিত ড্রয়ের মাধ্যমে আকর্ষণীয় পুরষ্কার জেতার সুযোগ থাকে। মূল টাকা ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকায় অনেকেই এটিকে ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করেন। তবে, প্রাইজবন্ডে বিনিয়োগ সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত কিনা তা নিয়ে কিছু ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। আসলে, প্রতিটি বিনিয়োগের মতোই প্রাইজবন্ডেও কিছুটা ঝুঁকি থাকে।

প্রাইজবন্ডে বিনিয়োগে ঝুঁকির মূল্যায়ন:
১। মূলধন সুরক্ষা
প্রাইজবন্ডের মূলধন সুরক্ষা বিনিয়োগকারীদের জন্য অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। এটি একটি সরকারি ঋণপত্র হওয়ায়, বিনিয়োগকারীদের অর্থ বাংলাদেশ সরকার দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। এটি বিশেষত তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যারা মূলধন হারানোর ঝুঁকি নিতে চান না। প্রাইজবন্ড কিনলে আপনি আপনার মূলধন হারানোর সম্ভাবনা থেকে মুক্ত থাকবেন, যা অন্য অনেক বিনিয়োগ মাধ্যমে পাওয়া যায় না।

২। ফলাফলের অনিশ্চয়তা
প্রাইজবন্ড থেকে প্রত্যাশিত ফলাফল বেশ অনিশ্চিত। ড্রয়ে জিতলে পুরস্কার পাওয়া যায়, তবে না জিতলে কোন লভ্যাংশ বা মুনাফা পাওয়া যায় না। এই কারণে প্রাইজবন্ডকে একটি অনিয়মিত আয়ের উৎস বলা যেতে পারে।
জেতার সম্ভাবনা: প্রতি ড্রয়ে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। ফলে, অধিকাংশ প্রাইজবন্ড ধারক দীর্ঘমেয়াদে কোনও মুনাফা পান না।
নিয়মিত আয়ের অভাব: প্রাইজবন্ড থেকে নিয়মিত লভ্যাংশ পাওয়া যায় না, তাই এটি আয় বৃদ্ধির জন্য নির্ভরযোগ্য নয়।

৩। মূল্যস্ফীতি ঝুঁকি
দীর্ঘমেয়াদে মূল্যস্ফীতি একটি বড় ঝুঁকি। মূল্যস্ফীতির কারণে টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে যেতে পারে।
মূল্যস্ফীতির প্রভাব: মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ফলে টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলে, প্রাইজবন্ডে বিনিয়োগ করা অর্থের প্রকৃত মূল্যও হ্রাস পেতে শুরু করবে। উদাহরণস্বরূপ, আজকে ১,০০০ টাকায় যতটা পণ্য কেনা সম্ভব, ১০ বছর পর সেই একই ১,০০০ টাকায় একই পরিমাণ পণ্য কেনা যাবে না, যদি মূল্যস্ফীতি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ, সময়ের সাথে সাথে আপনার বিনিয়োগের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে, যা ভবিষ্যতে আপনার আর্থিক লক্ষ্য অর্জনে প্রভাব ফেলতে পারে।

৪। পুনঃবিনিয়োগ ঝুঁকি
প্রাইজবন্ডে বিনিয়োগ করা অর্থ অন্য কোথাও পুনঃবিনিয়োগ করা সম্ভব নয় যতক্ষণ না সেই প্রাইজবন্ড বিক্রি করা হয় বা ড্রয়ে পুরস্কার জেতার মাধ্যমে অর্থ পাওয়া যায়।
সুযোগের ঝুঁকি: বাজারে অন্যান্য বিনিয়োগ বিকল্প, যেমন ফিক্সড ডিপোজিট বা রিয়েল এস্টেট প্রাইজবন্ডের তুলনায় অনেক বেশি রিটার্ন দিতে পারে। তবে, এই বিকল্পগুলোতে ঝুঁকিও বেশি থাকে।

৫। পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা
প্রাইজবন্ডে পুরস্কার পাওয়া নির্ভর করে ভাগ্যের উপড় এবং ধারণকৃত প্রাইজবন্ডের পরিমানের উপড়।
পুরস্কারের সংখ্যা ও পরিমাণ: প্রাইজবন্ডের তুলনায় পুরস্কারের সংখ্যা কম হলেও কিছু বড় পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে, বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ অংশগ্রহণকারী ড্রয়ে জিততে পারেন না। এর ফলে, বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী শুধুমাত্র তাদের মূলধন ফেরত পান, কিন্তু কোনো মুনাফা অর্জন করতে পারেন না।

যেসব ক্ষেত্রে প্রাইজবন্ড আকর্ষণীয় বিনিয়োগ হতে পারে
প্রাইজবন্ডে বিনিয়োগের বিভিন্ন সুবিধা এবং নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে এটি আকর্ষণীয় হতে পারে। নীচে কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্র উল্লেখ করা হল যেখানে প্রাইজবন্ড বিনিয়োগ হিসেবে বেশ লাভজনক হতে পারে:

১। ঝুঁকি এড়াতে চাইলে
যারা ঝুঁকি নিতে চান না তাদের জন্য প্রাইজবন্ড একটি ভালো বিকল্প। প্রাইজবন্ডে বিনিয়োগের অন্যতম বড় সুবিধা হল মূলধন সুরক্ষিত থাকে। প্রাইজবন্ড কিনে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, আপনার বিনিয়োগ করা মূল অর্থ ফেরত পাবেন। এটি বিশেষ করে সেইসব বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় যারা তাদের অর্থের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।

২। নিয়মিত আয়ের জন্য
প্রাইজবন্ড নিয়মিত ড্রয়ের মাধ্যমে আয়ের সুযোগ করে দেয়।
ড্রয়ের সুযোগ: প্রতি কয়েক মাস অন্তর প্রাইজবন্ডের ড্র অনুষ্ঠিত হয়, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য পুরস্কার জেতার সুযোগ এনে দেয়। নিয়মিত ড্রয়ের মাধ্যমে ছোট বড় পুরস্কার জিতে আয় করা সম্ভব। যারা নিয়মিত আয় চান, তাদের জন্য এটি একটি ভালো বিকল্প হতে পারে।
বিনিয়োগের পর আনন্দ উপভোগের সুযোগ: ড্রয়ে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ছোট বড় পুরস্কার জেতার আনন্দও একটি বিশেষ দিক। এটি অনেক বিনিয়োগকারীর জন্য একটি বিনোদনমূলক বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবেও কাজ করে।

৩। দীর্ঘমেয়াদী সঞ্চয়ের জন্য
দীর্ঘমেয়াদে সঞ্চয়ের জন্য প্রাইজবন্ড একটি ভালো বিকল্প হতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে প্রাইজবন্ড ধরে রাখলে, পুরস্কার জেতার সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পায়। ফলে, যারা দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করতে চান, তাদের জন্য এটি একটি ভালো বিকল্প।

৪। নিরাপদ এবং সুরক্ষিত
প্রাইজবন্ড একটি নিরাপদ এবং সুরক্ষিত বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়।
সরকারি গ্যারান্টি: এটি সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে, তাদের অর্থ নিরাপদ হাতে রয়েছে।
সন্দেহমুক্ত: প্রাইজবন্ডের নিয়মাবলী এবং কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে স্বচ্ছ এবং সন্দেহমুক্ত, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য আস্থা সৃষ্টি করে।

উপসংহার
প্রাইজবন্ডে বিনিয়োগে কিছু ঝুঁকি থাকলেও এটি একেবারে ঝুঁকিমুক্ত বলা যায় না। মূলধন সুরক্ষার দিক থেকে এটি তুলনামূলক নিরাপদ, তবে ফলাফলের অনিশ্চয়তা ও মূল্যস্ফীতি ঝুঁকি রয়েছে। তাই বিনিয়োগকারীদের উচিত প্রাইজবন্ডে বিনিয়োগ করার আগে তাদের আর্থিক লক্ষ্য ও ঝুঁকি সহনশীলতা বিবেচনা করা। পাশাপাশি, প্রাইজবন্ডের পাশাপাশি অন্যান্য বিনিয়োগ মাধ্যমেও বিনিয়োগ করে তাদের বিনিয়োগ পোর্টফোলিও বৈচিত্র্যময় করা উচিত, যাতে তারা ঝুঁকি কমাতে পারে এবং সম্ভাব্য লাভ বাড়াতে পারে। এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, কোনও বিনিয়োগ মাধ্যমই সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত নয় এবং সঠিক তথ্য ও জ্ঞান নিয়ে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সবসময়ই বুদ্ধিমানের কাজ।

২১৩ মন্তব্য (০/০) ২০ আগষ্ট ২০২৪

Latest Blog

পুরানো প্রাইজবন্ডে ড্র জেতার সম্ভাবনা কতটুকু?

আপনার কাছে যদি ১৯৯৫, ২০০০, ২০০২ সালের পুরাতন প্রাইজবন্ড থাকে, হতাশ হবেন না! অনেকেই ভাবতে পারেন এত পু...

১৩ মে ২০২৪ ১,১২৯

১১৬তম প্রাইজবন্ডের ড্র অনুষ্ঠিত হয়েছে।

৩১শে জুলাই ২০২৪, বুধবার প্রাইজবন্ডের ১১৬তম ড্র অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই ড্র'তে মোট আশি সিরিজের প্রাইজবন্ডে...

৩১ জুলাই ২০২৪ ২১,৮০৫

প্রাইজবন্ড কিভাবে কিনতে হয়?

সারাদেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০টি শাখা অফিস থেকে সারা বছর এবং যেকোনো সময় প্রাইজবন্ড কেনা যায়। এছাড়াও...

০৭ মে ২০২৪ ১,০২০

প্রাইজবন্ড কোথায় ছাপানো হয়?

বাংলাদেশের প্রাইজবন্ড ঢাকার গাজীপুরে অবস্থিত সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন বাংলাদেশ লিমিটেড (এসপিসিব...

২৮ মে ২০২৪ ৫০৪

প্রাইজবন্ডের ক্ষতিকর দিকগুলো কী কী?

প্রাইজবন্ডের কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে।  ১. অনিশ্চয়তা: প্রাইজবন্ডের প্রধান নেতিবাচক দিক হলো এর অনিশ্...

১৮ মে ২০২৪ ১,০০১

প্রাইজবন্ড কর্তৃপক্ষের প্রতি খোলা চিঠি

১৯৯৫ সালে প্রাইজবন্ড চালু হলেও, গ্রাহকবান্ধব সংস্কারের অভাবে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। গ্রাহকদের ভোগান্ত...

২২ মে ২০২৪ ১,৩৯০

প্রাইজবন্ড একবার কিনে কতবার ড্রয়ে অংশ নেওয়া যায়?

প্রাইজবন্ড একবার কিনলে শুধু একবারই ড্র-এর আওতায় আসবে না। প্রাইজবন্ড হল বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক পরিচা...

১৩ মে ২০২৪ ৬৮১

কাস্টমার রিভিউ

শ্রোতাদের কথা: আমরা আমাদের গ্রাহকদের মতামতকে মূল্য দিই! ফেসবুক, ইউটিউব, গুগল সহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম...

২৮ অক্টোবর ২০২১ ৬২৭

প্রাইজবন্ডে লভ্যাংশের হার কত?

প্রাইজবন্ডে সরাসরি লভ্যাংশের হার নির্ধারিত নেই। বাংলাদেশের প্রাইজবন্ড ছোট ও মাঝারি আয়ের লোকেদের জন্...

১৮ মে ২০২৪ ৭৭৫

প্রাইজবন্ড সম্পর্কিত ব্লগ সমূহ